নব আবিষ্কৃত সব আমলই কি বিদয়াত? বিদয়াত ও এর সঠিক ব্যাখ্যা


বিদয়াতের লোগাতী অর্থঃ 
“বিদয়াত হলো দ্বীনের পূর্ণতার পর নতুন কোন বিষয় উদ্ভব হওয়া অথবা হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পর আমল ও খাহেশাত সম্পর্কিত কোন বিষয় নতুন উদ্ভব হওয়া।” (লোগাতুল কামূস আল মহীত্ব ৩য় জিলদ্‌ পৃষ্ঠা ৩, বয়ানুল লিসান পৃষ্ঠা ১১৫, লিসানুল আরব ১ম জিলদ্‌ পৃষ্ঠা ২২৯, তাজুল উরুস ৫ম জিলদ্‌ পৃষ্ঠা ২৭১, লোগাতে হীরা পৃষ্ঠা ১৭৫, গিয়াসুল লোগাত পৃষ্ঠা ৭১) 

বিদয়াতের শরীয়তী অর্থঃ 
বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ আল্লাম বদরুদ্দীন আইনী হানাফী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন, “প্রকৃতপক্ষে বিদয়াত হলো- এমন জিনিসের আবির্ভাব যার নমুনা হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় ছিলনা।”(উমদাতুল ক্বারী ৫ম জিলদ্‌ পৃষ্ঠা ৩৫৬, আল ইতেছাম জিলদ্‌ পৃষ্ঠা ২০) 


উপরোক্ত লোগাতী ও শরীয়তী অর্থের আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, বিদয়াত হলো- হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পর থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভাবিত বিষয়ের কোনটি শরীয়তে গ্রহণযোগ্য ও কোনটি পরিত্যাজ্য, তা অবশ্যই ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। 
তাই বিদয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত হাদীস শরীফের কিতাব মিরকাত শরীফে উল্লেখ করেছেন, 
“ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যে নব উদ্ভাবিত কাজ কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, আসার( সাহাবা-ই-ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের আমল বা কাওল) অথবা ইজমার বিরুদ্ধ বলে প্রমাণিত, সেটাই গোমরাহী ও নিকৃষ্ট। আর যে নব উদ্ভাবিত কাজ উল্লেখিত কোনটির বিপরীত বা বিরুদ্ধ নয়, তা মন্দ বা নাজায়েয নয়।” (মিরকাত শরীফ, ১ম জিলদ্‌ পৃষ্ঠা ১৮৯) 

বিদয়াতের শ্রেণী বিভাগঃ 
ইমাম, মুজতাহিদ্গণ শরীয়তের বিধান অনুযায়ী বিদয়াতকে প্রধানতঃ ২ ভাগে ভাগ করেছেন, 
(১) বিদয়াতে ই’তেক্বাদী (আক্বীদা বা বিশ্বাসগত বিদয়াত:  যে সমস্ত আক্বীদা বা বিশ্বাস কুরআন ও সুন্নাহর মুলনীতির বহির্ভূত, মূলতঃ এ আক্বীদাগত বিদয়াতের সবটাই হারামের পর্যায়ভুক্ত এবং অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেমনঃ খারেজী, মু’তাজিলা, জাবারিয়া, ক্বদরিয়া, শিয়া ইত্যাদি বাতিল ফিরক্বাহর আবির্ভাব। এই নব্য আবির্ভূত ফিরক্বাহর ন্যায় আক্বীদা পোষণ করা সম্পূর্ণ হারাম ও কুফরী। 

(২) বিদয়াতে আ’মলী ( কর্মগত বিদয়াত) : একে আবার ২ ভাগে ভাগ করা যায়।

(ক) বিদয়াতে হাসানাঃ বিদয়াতে হাসানা সম্পর্কে হাদীছে শরীফে ইরশাদ হয়েছে, 
“যে কেউ দ্বীন ইসলামের উত্তম কোন পদ্ধতি উদ্ভাবন করবে ( যা শরীয়ত সম্মত), তার জন্য সে সওয়াব পাবে এবং তারপরে যারা এ পদ্ধতি অনুসরণ করবে, তার সাওয়াবও সে পাবে।” ( মুসলিম শরীফ) 
বিদয়াতে হাসানা আবার ৩ প্রকার –
(১)বিদয়াতে ওয়াজিবঃ যা পালন না করলে ইসলাম ক্ষতি বা সংকট হবে, যেমনঃ কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ কাগজে লিপিবদ্ধ করা, কুরআন শরীফের জের, যবর, পেশ দেওয়া, মাদ্রাসা নির্মাণ করা, নাহু সরফ, উসুল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কিতাব লেখা ও পড়া। 
(২) বিদয়াতে মোস্তাহাবঃ যা শরীয়তে নিষেধ নেই এবং তা সমস্ত মুসলমানগণ ভাল মনে করে সাওয়াবের নিয়তে করে থাকেন। যেমনঃ তারাবীহ নামায জামায়াতে পড়া, খতিবের সম্মুখে আযান দেওয়া, রমজান মাসে বিতর নামায জামায়াতে আদায় করা ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, 
“হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, লোকে যা ভাল মনে করে তা আল্লাহ পাক-এর নিকটও ভাল। আমার উম্মত কখনো গোমরাহীর মধ্যে একমত হবে না।” ( মেশকাত শরীফ) 
(৩) বিদয়াতে মোবাহঃ ঐ সমস্ত নতুন কাজ যা শরীয়তে নিষেধ নেই। যেমনঃ পোলাও, বিরিয়ানী, বুট, পিয়াজু ইত্যাদি খাওয়া, ট্রেন, বাস, প্লেন ইত্যাদি যানবাহনে চড়া,মসজিদে মেহরাব ব্যবহার করা, মিনার ব্যবহার করা, মাইক ব্যবহার ইত্যাদি। 

(খ) বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহঃ বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ সম্পর্কে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, 
“যে ব্যক্তি আমার দ্বীনের ভিতরে কোন নতুন জিনিসের প্রবর্তন করবে, যার ভিত্তি এ দ্বীনে নেই, তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।” (মেশকাত শরীফ) 

আর বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ ২ প্রকার –

১. বিদয়াতে হারামঃ যা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফের পরিপন্থী বা ওয়াজিব আমলগুলো ধ্বংসের কারণ। যেমনঃ ইহুদী, নাসারা ও ভন্ড ফকিরদের কু-প্রথা বা আক্বীদাসমূহ। 
২. বিদয়াতে মাকরূহঃ যা দ্বারা কোন সুন্নত কাজ বিলুপ্ত হয়ে যায়। যেমনঃ বিধর্মীদের পোশাক পরিধান করা, টাই পরা ইত্যাদি। 

মূল কথা হলো- যা হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পর নতুন উদ্ভব হয় এবং তা দ্বীনের সাহায্য করে থাকে অথবা সাহায্যকারী না হলেও দ্বীনের কোন ক্ষতি করে না, সেটাই বিদয়াতে হাসানা। আর যে নতুন বিষয় উদ্ভব হওয়ার কারণে দ্বীনের কিছু মাত্রও ক্ষতি হয়, সেটাই বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ। 

উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বিদয়াত বলতেই পরিত্যাজ্য নয়। অর্থাৎ যে নতুন উদ্ভাবিত কাজ কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের বিপরীত তা অবশ্যই বর্জনীয়। আর সেটাই বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ বা হারামের অন্তর্ভূক্ত, যদিও তা “কুরুনে সালাসার” (হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরবর্তী ৩ যুগ) মধ্যে উদ্ভাবিত হোক না কেন। আর যেই নতুন পদ্ধতি কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের অনুকূলে তা অবশ্যই জায়েজ এবং উত্তম। আর সেটাকেই বিদয়াতে হাসানা বলা হয়। যদিও তা “কুরুনে সালাসার” পরে উদ্ভাবিত হয়। 
পূর্ববর্তী পোস্ট
পরবর্তী পোস্ট