বাদশাহ আবু সাঈদ মুজাফফার রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং আবু খাত্তাব উমর ইবনে দিহইয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে বানোয়াট উক্তি প্রচার করল দেওবন্দী/হিফাজতিরা।


দেওবন্দী/কওমী/হেফাজতিদের গুরু জুনায়েদ বাবু নগরী তার মিলাদ বিরোধী লিখায় বাদশাহ আবু সাঈদ মুজাফফার রহমতুল্লাহি আলাইহি  এবং আবু খাত্তাব উমর ইবনে দিহইয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি কে অপব্যয়ী ও দ্বীনের প্রতি উদাসীন হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে লিখে
১.“তিনি ছিলেন এক অপব্যয়ী বাদশা। তিনি নিজস্ব ইজতিহাদ ও অভিরুচি মতে আমল করার জন্য সমকালীন আলেমদের আদেশ দিতেন এবং অন্য ইমামের অনুসরণ না করার জন্য উৎসাহ যোগাতেন। ফলে (স্বার্থপর) আলেমদের একটি দলকে তিনি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি প্রতি রবীউল আউওয়াল মাসে মীলাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। সেই প্রথম বাদশা যিনি এই নবতর প্রথার ভিত্তি স্থাপন করেন।”নাউযুবিল্লাহ  (আল কাউলুল মু’তামাদ ফী আমালিল মাওলীদ, মিন্হাযুল ওয়াযিহ্-২৪৯)।


এই অপব্যয়ী বাদশা প্রজাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য ধর্মের নামে বাইতুল মালের টাকা মীলাদুন্নবীর আয়োজনে পানির মত ব্যয় করতেন। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আল্লামা যাহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সম্পর্কে লিখেন, “তিনি প্রতি বছর মীলাদুন্নবী উপলক্ষে প্রায় তিন লক্ষ দিনার ব্যয় করতেন।” (দুয়ালুল ইসলাম-২/১৩৬)।
২. আল্লামা ইব্নে কাসীর ও আল্লামা ইব্নে খাল্লিক্বান রহমতুল্লাহি আলাইহিমা  লিখেন, “কোন কোন মীলাদ মাহ্ফিলে সেই বাদশার দস্তররখানে পাঁচ হাজার ভূনা মাথা, দশ হাজার মুরগী এবং ত্রিশ হাজার হালুয়ার পাত্র থাকত। মাহ্ফিল স্থানে স্থাপন করা হত বিশটিরও অধিক চার পাঁচ তলা বিশিষ্ট গম্বুজ। তন্মধ্যে একটি গম্বুজ বাদশার জন্য নির্দিষ্ট থাকতেন। অবশিষ্ট গম্বুজগুলোতে অবস্থান করতেন বাদশার উজির-নাজির ও সভাসদবর্গ। সফর মাস থেকেই শুরু হত গম্বুজ সাজানোর কাজ। এ মাহ্ফিলে অত্যন্ত ধুমধামের সাথে আসর বসত। বাদশা নিজে অংশগ্রহণ করতেন। মাহ্ফিল শেষে যোগদানকারীদের যথাযোগ্য সম্মানীও দেওয়া হত।” 
• তারীখে ইব্নে কাসীর-১৩/১৩৭, 
• তারীখে ইব্নে খাল্লিক্বান-৪/১১৭-১১৯
৩. সুপ্রসিদ্ধ ‘দুয়ালুল ইসলাম’ ইতিহাস গ্রন্থে দেখা যায়, উপরোক্ত বাদশার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মীলাদ মাহ্ফিলের বৈধতা ব্যাখ্যা করে আবুল খাত্তাব উমর ইব্নে দিহ্য়া রহমতুল্লাহি আলাইহি (মৃতঃ ৬৩৩ হিজরী) ‘আত-তানবীর ফী মাওলিদিস্ সিরাজিল মুনীর’ নামক একটি কিতাব রচনা করেছিলেন। এজন্য সে বাদশার পক্ষ থেকে এক হাজার দিনার বখশিশ লাভ করেছিলেন। 
• খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১৩। 
৪. এই মৌলবী সম্পর্কে আল্লামা হাফেজ ইব্নে হাজার আসক্বালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেন, “তিনি পর্ববর্তী ইমাম ও আলেম-উলামাদের সাথে বেআদবী করতেন। তিনি ছিল অশ্লীল ভাষী, অহঙ্কারী, নির্বোধ এবং দ্বীন সম্পর্কে সংকীর্ণমনা ও অলস প্রকৃতির।নাউযুবিল্লাহ ” (লিসানুল মীযান-৪/২৯৬, আল্ মিন্হাযুল ওয়াযিহ্)। 
তিনি আরও লিখেন, “আল্লামা ইব্নুন্ নাজ্জার মন্তব্য করেন যে, আমি এই মৌলবীর মিথ্যাচার ও দুর্বলতা সম্পর্কে লোকদের একমত দেখেছি।” (লিসানুল মীযান-৪/২৯৬, আল্ মিনহাযুল ওয়াযিহ্)

হেফাজত নেতা বাবু নগরীর উপরের মন্তব্য হল প্রকৃত তথ্যের বিকৃত রূপ। সকল ইমাম মুস্তাহিদগন তাদের সম্পর্কে কি বলেছেন তা দেখা যাক–

১. হাফিজে হাদীস ইমাম যাহাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার কিতাবে লিখেন-
অর্থ: বাদশা হযরত মালিক মুজাফফরুদ্দীন ইবনে যাইনুদ্দীন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি নম্র, ভদ্র ও উত্তম স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ফক্বীহ ও মুহাদ্দিসগনকে অত্যন্ত ভালবাসতেন।”
• সূত্রঃ- সিয়ারু আলামীন নবালা, ২২ তম খন্ড, ৩৩৬ পৃষ্ঠা

২. এ মহান বাদশার প্রশংসায় উনার সমকালীন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আল্লামা ক্বাযী ইবনে খল্লিক্বান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার কিতাবে লিখেন-
অর্থ: বাদশা হযরত মুজাফফরুদ্দিন ইবনে যাইনুদ্দীন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি প্রসংসনীয়, চরিত্রের অধিকারী, অত্যধিক বিনয়ী ছিলেন। উনার আক্বীদা ও বিশ্বাস ছিল সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ। তিনি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। তিনি আলিম উলামা, ফক্বীহ ও মুহাদ্দিসগন উনাদের পিছনে ব্যয় করা ব্যতীত সকল ক্ষেত্রে ব্যয় করার ব্যাপারে মিতব্যয়ী ছিলেন।”
• সূত্রঃ- ওয়াফইয়াতুল আ’ইয়ান, ৪র্থ খন্ড, ১১৯ পৃষ্ঠা

এ মহান বাদশা বিশুদ্ধ আক্বীদা এবং উত্তম আমলের অধিকারী ছিলেন বলেই সে জামানার সকল আলিম উলামা, মাশায়েখ, সূফী দরবেশ সবাই সে সময় উনার আয়োজিত মীলাদ শরীফ মাহফিলে উপস্থিত হতেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ক্বাযী ইবনে খল্লিক্বান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

অর্থ: বাদশা হযরত মুজাফফরুদ্দীন ইবনে যাইনুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি কতৃক আয়োজিত মীলাদ শরীফ এর মাহফিলের গুরুত্ব-মাহাত্ব বলে শেষ করার মত নয়। এতদসত্বেও একটি কথা না বললেই নয়। তাহলো দেশবাসী আক্বীদা ও বিশ্বাসে উনাকে উত্তম লোক বলেই জানতেন। আর তাই প্রতি বছর আরবলের নিকটবর্তী সকল দেশে যেমন-বাগদাদ, মাওয়াছিল, জাযীরাহ, সানজার, নাছীবাইন, আরব-অনারব ও আশ পাশের অসংখ্য আলীম উলামা, ফক্বীহ, ছালিহ, ওয়ায়িজ, ক্বারী ও শায়িরগন উক্ত মীলাদ শরীফ এর মাহফিলে উপস্থিত হতেন।”

• সূত্রঃ- ওয়াফইয়াতুল আ’ইয়ান, ৪র্থ খন্ড, ১১৭ পৃষ্ঠা

আবুল খত্তাব ইবনে দাহইয়া রাহমাতুল্লাহি এর পরিচয় - 
আবুল খত্তাব ইবনে দাহইয়া রাহমাতুল্লাহি এর পরিচয় দিতে গিয়ে ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লেকান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, “তারীফে ইবনে খাল্লেকানে” লিখেছেন,“তিনি তৎকালীন বিখ্যাত ও নেতৃস্থানীয় আলিম বিদ্বানগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি পশ্চিমের কোন এক দেশ হতে আগমন করে শাম ও ইরাক সফর করেন এবং হিজরী ৬০৪ সালে ‘আরবল’ শহরে আগমন করে সেখানেই অবস্থান করেন। তখনকার বাদশাহ্ মালিক মুজাফফরকে মীলাদুন্নবীর প্রতি যথেষ্ট আগ্রহান্বিত ও যত্নপরায়ণ দেখে উনার এই কর্মের সমর্থনে ﺍﻟﺘﻨﻮﻳﺮ নামক একটি কিতাব প্রণয়ন করেন।”
আল্লামা ক্বাযী ইবনে খল্লিক্বান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আরও বলেন,

“ইবন দিহইয়া ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত ওলামা ও প্রসিদ্ধ ফোজালাগণের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব। তিনি মরক্ক থেকে আগমণ করে পর্যটনের উদ্দেশ্যে সিরিয়া ও ইরাকে প্রবেশ করেন এবং ৬০৪ হিজরী সালে (কুর্দিস্তানের) আরবিল শহরে আগমন করেন। তিনি তথাকার সম্মানীত শাসক ও বাদশাহ মুজাফফার উদ্দিনকে মিলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালন করতে দেখতে পান। তিনি বাদশাহকে উপহার দিয়ার উদ্দেশ্যে ‘আত-তানভির ফি মাওলিদিল বাশিরিন নাজির’ নামক একখান গ্রন্থ মিলাদ শরীফের উপর রচণা করে উপহার প্রদান করেন। তিনি নিজে গ্রন্থখানা পাঠ করে বাদশাহকে শুনান। বাদশাহ প্রীত হয়ে তাঁকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা উপহার দেন”।
[সূত্রঃ- আন নিয়ামাতুল কুবরা আলাল আলম পৃঃ ৭৬, ৯ম শতাব্দী মুজাদ্দিদ আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি রহমতুল্লাহি আলাইহি এর ফতওয়া সূত্র বর্ণিত]

৩. হাফিজুল হুফফায, ইমামুল মুহাদ্দিসীন, ৯ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত “আল হাবীলিল ফতওয়া” নামক কিতাবে বর্ণনা করেন,“যিনি এই প্রকার মীলাদ মাহফিলের প্রবর্তন করেন, তিনি হলেন আরবালের বাদশাহ্ মালিক মুজাফফর আবূ সাইদ বিন জয়নুদ্দীন।”

ইমাম সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি উক্ত বাদশাহ্ সম্বন্ধে উনার “হুসনুল মাকাসিদ ফি আমালিল মাওয়ালিদ” কিতাবে সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিছ আল্লামা ইবনে কাসির রাহমতুল্লাহি আলাইহি উনার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে,

অর্থ: “তিনি তীক্ষ্ম বুদ্ধি-সম্পন্ন, সাহসী, বীর্যবান, আলিম ও ন্যায় বিচারক ছিলেন। আল্লাহ্ পাক উনার প্রতি রহম করুন উনাকে সম্মানিত বাসস্থান দান করুন।”শায়খ হাফিয আবুল খত্তাব ইবনে দাহইয়া বাদশাহর এই মীলাদ অনুষ্ঠান সম্পর্কে এক বৃহৎ কিতাব প্রণয়ন করে তার নাম দিয়েছেন, “আততানবীরু ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর।”

৪. প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনু জাওজী রাহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নাতি ‘মিরআতুজ্জামান’ নামক পুস্তকে বলেন,
“তাঁর (বাদশাহর) আয়োজিত মীলাদ মাহফিলে শীর্ষস্থানীয় সূফী ও আলিমগণ উপস্থিত হতেন।”