ঈদ মিলাদুন্নবি উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করা সকলের জন্যেই ফরযে আইন -১


নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদত শরীফ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে ব্যয় করার আহকাম ও ফযীলত

প্রত্যেক ঈমানদার বান্দা ও উম্মতের দায়িত্ব কর্তব্য হলো, আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে সন্তুষ্ট ও মুহব্বত করা। এ প্রসঙ্গে কালামুল্লাহ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

والله ورسوله احق ان يرضوه ان كانوا مؤمنين

অর্থ: যদি তারা মু’মিন হয়ে থাকে তাহলে তারা যেনো আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে সন্তুষ্ট করে। কেননা উনারাই সন্তুষ্টি পাওয়ার সমধিক হক্বদার। (সূরা তওবা:৬২)



হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন-

احبونى لحب الله

অর্থ: তোমরা আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত হাছিল করার জন্য আমাকে মুহব্বত করো। (তিরমিযী, মিশকাত)

উল্লেখিত আয়াত শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রত্যেক মু’মিন মুসলমানের জন্য আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে সন্তুষ্ট ও মুহব্বত করা ফরযে আইন। আরো প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহ পাক উনাকে মুহব্বত করতে হলে ও সন্তুষ্ট করতে হলে প্রথমে উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সন্তুষ্ট করতে ও মুহব্বত করতে হবে। অর্থাৎ হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুহব্বত ও সন্তুষ্টি ব্যতীত আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত ও সন্তুষ্টি হাছিল করা সম্ভব হবে না।

উল্লেখ্য, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কিরূপ মুহব্বত করতে হবে সে প্রসঙ্গে তিনি নিজেই ইরশাদ করেন-

لا يؤمن احدكم حتى اكون احب اليه من والده وولده والناس اجمعين وفى رواية من ماله ونفسه.

অর্থ: তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি এবং সমস্ত মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি মুহব্বত না করবে। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, তার মাল ও জান অপেক্ষা বেশি মুহব্বত না করবে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত)

এ হাদীছ শরীফ-এর বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মধ্যে। উনারা উনাদের সবকিছু থেকে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মুহব্বত করেছেন। উনার খিদমতে উনারা উনাদের সর্বস্ব কুরবানী করে দিয়েছেন, একদিকে মাল আরেকদিকে জীবন উৎসর্গ করতে উনারা কোনরূপ দ্বিধা করেননি।

তিরমিযী, আবূ দাউদ, মিশকাত শরীফ ইত্যাদি হাদীছ শরীফ-এর কিতাবে বর্ণিত রয়েছে, হযরত উমর ফারূক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, একবার নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাদেরকে আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় দান করার জন্য নির্দেশ করলেন, সৌভাগ্যবশত: সে সময় আমার কাছে পর্যাপ্ত সম্পদ ছিলো। আমি (মনে মনে) বললাম, দানের প্রতিযোগিতায় যদি কখনো হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার উপর জয়ী হতে পারি তাহলে আজকের দিনেই জয়ী হবো। তাই আমি আমার সমস্ত সম্পদের অর্ধেক নিয়ে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমতে উপস্থিত হলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আপনার পরিবার পরিজনের জন্য কি পরিমাণ রেখে এসেছেন? আমি বললাম, এর সমপরিমাণ অর্থাৎ যে পরিমাণ নিয়ে এসেছি অনুরূপ পরিমাণ রেখে এসেছি। অতঃপর হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উনার সমুদয় সম্পদ নিয়ে উপস্থিত হলে নূরে মুজসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাকে বললেন, পরিবার-পরিজনের জন্য আপনি কি রেখে এসেছেন? জাওয়াবে তিনি বললেন, আমি উনাদের জন্য আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মুহব্বতটুকু রেখে এসেছি। সুবহানাল্লাহ!

অনুরূপভাবে প্রত্যেক ছাহাবাযে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা উনাদের সর্বোচ্চ তাওফীক্ব অনুযায়ী জিহাদ কিংবা অন্যান্য নেক কাজে দান করেছেন।

মুসনাদে আহমদ, মিশকাত, মাছাবীহুস সুন্নাহ ইত্যাদি হাদীছ শরীফ-এর কিতাবে বর্ণিত রয়েছে, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে সামুরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন তাবূক জিহাদের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন হযরত উছমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি স্বীয় জামার আস্তিন ভর্তি করে এক হাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) নিয়ে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট আসলেন এবং দীনারগুলি উনার কোল মুবারকে ঢেলে দিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি দেখলাম, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মুদ্রাগুলি উলট-পালট করছেন এবং বলছেন, আজকের পর থেকে হযরত উছমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে কোনো ক্ষতি করবে না- তিনি যে আমলই করেন না কেনো। সুবহানাল্লাহ!

হযরত উছমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার দানের বিষয়ে আরো বর্ণিত রয়েছে, খলীফাতু রসূলিল্লাহ হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার খিলাফতকালে একবার মদীনা শরীফ-এ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন বাইতুল মালেও কোন খাদ্য ছিলো না। ঠিক সেই মুহূর্তে হযরত উছমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার একটি বাণিজ্য কাফেলা এক হাজার উট বোঝাই করা খাদ্য নিয়ে সিরিয়া থেকে মদীনা শরীফ-এ উপস্থিত হলো। ব্যবসায়ী লোকজন উনার নিকট আসতে লাগলো খাদ্য কিনে নেয়ার জন্য। কেউ স্বাভাবিক দামে, কেউ দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ দামেও খাদ্য কিনতে প্রস্তুত। তবুও তিনি উনাদের কারো নিকট খাদ্য বিক্রি করতে রাজি হলেন না। তিনি উনার সমস্ত খাদ্য-দ্রব্য আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সন্তুষ্টির জন্য বাইতুল মালে দান করে দিলেন। সুবহানাল্লাহ! অতঃপর খলীফার তরফ থেকে সমস্ত খাদ্য-দ্রব্য মদীনা শরীফ-এর অধিবাসীদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়। এতে দুর্ভিক্ষ দূর হয়ে যায়।

হযরত উছমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি যেদিন এই দান করলেন সেই রাতে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি স্বপ্নে দেখতে পেলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সবুজ রং এর খুব দামী পোশাক পরিধান করতঃ বোরাকে চড়ে কোথাও যাচ্ছেন। তা দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বললেন, তুমি কি জানো না আজকে হযরত উছমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি মদীনা শরীফবাসীকে যে একহাজার উট বোঝাই খাদ্য দান করেছেন যার কারণে মদীনা শরীফ-এর দুর্ভিক্ষ দূর হয়ে গেছে; তাই উনার দানে সন্তুষ্ট হয়ে স্বয়ং আল্লাহ পাক তিনি আজকে বেহেশতে মেহমানদারীর ব্যবস্থা করেছেন। আমি সেই মেহমানদারীতে শরীক হওয়ার জন্য যাচ্ছি। সুবহানাল্লাহ!

স্মরণীয় যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের উক্ত দানসমূহ ছিলো দ্বীন ইসলাম বা উম্মতের কল্যাণ সাধনে। এখন উম্মতের উদ্দেশ্যে ব্যয় করলে যদি আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারা এতো খুশি হয়ে থাকেন তাহলে আল্লাহ পাক উনার যিনি হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য, উনার মীলাদ বা বিলাদত শরীফ উপলক্ষে ব্যয় করলে উনারা কত বেশি খুশি হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

যেমন এ প্রসঙ্গে বুখারী, মিশকাত, মাছাহাবীহুস সুন্নাহ ইত্যাদি হাদীছ শরীফ-এর কিতাবে বর্ণিত রয়েছে, হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন-

¬¬¬لاتسبوا اصحابى فلو ان احدكم انفق مثل احد ذهبا ما بلغ مد احدهم ولا نصيفه

অর্থ: “আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে তোমরা গাল-মন্দ, সমালোচনা বা দোষারোপ করো না। তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় দান করো, তবুও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা আমার খিদমতে এক মুদ (১৪ ছটাক) বা অর্ধ মুদ (৭ ছটাক) গম হাদিয়া করে যে ফযীলত অর্জন করেছেন তার সমপরিমাণ ফযীলত তোমরা অর্জন করতে পারবে না।”

প্রতিভাত হলো যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমতের হাদিয়া বা ব্যয় করার ফযীলত যে কতো বেশি তা কেবল আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারাই সম্যক অবগত আছেন।

কাজেই, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য হাদিয়া করে যে বেমেছাল ফযীলত হাছিল করেছেন পরবর্তী উম্মত যদি সেই ফযীলতের অনুরূপ ফযীলত হাছিল করতে চায় তাহলে তাদের কর্তব্য হলো- নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদত শরীফ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে সর্বোচ্চ তাওফীক্ব বা সাধ্য সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করা। 

পূর্ববর্তী পোস্ট
পরবর্তী পোস্ট