ঈদে মিলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝতে বিবেক লাগে ...

আনন্দানুষ্ঠানকে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে ঈদ (عيد)। অভিধানে ঈদ বলতে বুঝায় :  ‘কোন মর্যাদাবান ব্যক্তি অথবা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমবেত হওয়ার দিন বা স্মৃতিচারণের দিবসই ঈদ। কেউ কেউ বলেছেন, ঈদকে এজন্যই ঈদ বলা হয় যে, প্রতিবছর নব আনন্দ নিয়ে তা ফিরে আসে।’ (আল-মুন্জিদ, পৃ. ৫৩৯)

আর মিলাদ ميلاد শব্দের অর্থ وقت الولادة জন্ম সময়। (আল-মুনজিদ, পৃ. ৯১৮)। পারিভাষিক অর্থে মিলাদ বলতে জন্ম সময়, জন্ম বৃত্তান্ত তথা কারো জন্ম তারিখে তার জীবন চরিত আলোচনা ও তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের অঙ্গীকার করা। মিলাদ শব্দটি যদিও আরবি, কিন্তু আমাদের দেশে এর প্রচলন ফারসি ভাষা থেকে হয়েছে। অনেকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট না জেনে এ শব্দটি আরবি ভাষার আঙ্গিকে তুলে ধরে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করেন। ফারসিতে মিলাদ অর্থ زمان تولد জন্ম সময়। (ফারহাঙ্গে জবানে ফারসি, পৃ. ১০৬৭)



১. কোন নেয়ামত ও রহমত লাভ করলেই আনন্দোৎসব করা যেরূপ মানুষের স্বভাবজাত কাজ তদ্রূপ আল্লাহ তাআলার নির্দেশও তাই। যেমন কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে : "হে মানুষ! তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের অন্তরের রোগ-ব্যাধি নিরাময় তথা সব মুমিনের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে হেদায়াত বা পথনির্দেশনা।“(হে রাসূল! আপনি মুমিনদেরকে) বলে দিন, তারা যেন কেবল আল্লাহর অনুগ্রহ এবং রহমতেই আনন্দিত হয়। কেননা- তারা যা জমায়, তার চেয়ে এটাই তাদের জন্যে শ্রেয়।" (১০:৫৮)


২. আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি "আদ্দুররুল মানসুর" তাফসীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এ আয়াতের তাফসীরে বলেন : ‘এখানে ‘আল্লাহর অনুগ্রহ’ বলতে ইল্ম বুঝানো হয়েছে। আর ‘রহমত’ দ্বারা বুঝানো হয়েছে হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘আমিতো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)

অর্থাৎ তোমরা মহামূল্যবান সম্পদ আল-কুরআন ও হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পেয়েছ, এর জন্য আনন্দ করা তোমাদের অন্যতম কাজ। যদি কুরআন মজীদ ও দীন ইসলাম পাওয়ার কারণে আনন্দ করতে হয় তাহলে যার মাধ্যমে কুরআন ও দীন পেয়েছি, যিনি ছিলেন সমগ্র জগতের রহমত, তাঁর আগমন যে কত বড় নেয়ামত ও রহমত তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না।

৩. আবদুল হক মুহাদ্দেসে দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাইতো তাঁর রচিত ‘মা সাবাতা মিনাসসুন্নাহ’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘হাজার মাসের চেয়ে উত্তম লাইলাতুল কাদর, ফজিলতের রাত্রি শবে বরাত, শবে মেরাজ, দুই ঈদের রাত এ সবই রাহমাতুল্লিল আলামীনকে দান করা হয়েছে। যাঁকে দান করা রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, স্বয়ং তাঁর আগমন দিবস যে কত লক্ষ-কোটি দিবস-রজনীর চেয়ে উত্তম তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।’

৪. সামান্য জাগতিক নেয়ামত লাভ করলেও তার জন্য ঈদ উৎসব করার সরাসরি উদাহরণ আমরা আল-কুরআনে দেখতে পাই। যেমন আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ কামনা করে হযরত ঈসা আলাইহি সালাম যে দোয়া করেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য। এরশাদ হয়েছে : ‘ঈসা ইবনে মারইয়াম বলল : হে আল্লাহ! আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য ঊর্ধজগৎ হতে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন। এ হবে আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকলের জন্য ঈদস্বরূপ, আর আপনার অন্যতম নিদর্শন।’ (সূরা মায়িদা : ১১৪)

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে খাঞ্চা ভরা খাওয়া পেলে তা যদি হযরত ঈসা আলাইহি সালাম-এর ভাষায় সৃষ্টির আদি হতে অন্ত পর্যন্ত আনন্দোৎসবের কারণ ও আল্লাহ তাআলার নিদর্শন হয় তাহলে সৃষ্টির সেরা মানব, রহমতের ভাণ্ডার হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মতো এ মহান নেয়ামতের আগমন দিবস কতই না মর্যাদাবান, গুরুত্ববহ, কতই না আনন্দের তা সহজেই অনুমেয়।

৫. হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন : ‘আবু লাহাবের মৃত্যুর পর তার বংশের একজন স্বপ্নে তাকে খুবই খারাপ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনার অবস্থা কি? সে জবাবে বলল, তোমাদেরকে ছেড়ে আসার পর আমার কল্যাণজনক কিছুই হয়নি, হ্যাঁ, এই আঙ্গুল (শাহাদাত অঙ্গুলি) দ্বারা পানি পাই। কারণ, এ আঙ্গুলের ইশারায় আমি দাসী সুয়াইবাকে মুক্তি দিয়েছিলাম।’

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ "ফাতহুল বারী "এবং আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত ‘আইনী’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন : ইমাম সুহাইলী রহমতুল্লাহি আলাইহি উল্লেখ করেন যে, হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, ‘আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর তাকে স্বপ্নে দেখি যে, অত্যন্ত দুরবস্থার মাঝে পতিত রয়েছে। সে বলল, ‘তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর আমি শান্তির মুখ দেখিনি। তবে প্রতি সোমবার আমার আযাব লাঘব করা হয়।’ হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন : ‘তার এ আযাব লাঘবের কারণ হলো হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মদিন ছিল সোমবার। উনার  জন্মের সুসংবাদ নিয়ে আসায় দাসী সুয়াইবাকে সে খুশিতে মুক্তি দেয়। (ফাতহুল বারী, ৯ম খ-, পৃ. ১১৮; আইনী, ২০/৯৫)

যে কাফের সম্পর্কে কুরআন মজীদে সরাসরি নাযিল হয়েছে :

 ‘ধ্বংস হয়েছে আবু লাহাবের দু’হাত এবং সে নিজেও।’ সে যদি একজন কাফের হওয়া সত্ত্বেও ঈদে মিলাদুন্নবী  ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এর খুশির কারণে তার প্রতি সোমবার আযাব লাঘব হয়, শাহাদাত অঙ্গুলি দিয়ে পানি বের হয়- যা খেয়ে সে তৃপ্ত হয়, একজন মুসলমান ঈদে মিলাদুন্নবী  ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপন ও আনন্দানুষ্ঠান করলে তাতে রহমত, বরকত লাভ এবং আযাব থেকে মুক্তিলাভের এক বিরাট সুযোগ তা যে কোন বিবেকবান ব্যক্তি সহজেই অনুধাবন করতে পারে। 



যেসব গ্রন্থ অবলম্বনে লিখিত

  ১. কুরআন মজীদ

  ২. বুখারী শরীফ- ইমাম বুখারী

  ৩. উমদাতুল কারী ফি শারহিল বুখারী- বদরুদ্দিন আইনী

  ৪. ফাতহুল বারী ফি শারহিল বুখারী- ইবনে হাজার আসকালানী

  ৫. মিশতাকুল মাছাবিহ- ওলীউদ্দিন খতিব

  ৬. মিরকাতুল মাফাতিহ- মোল্লা আলী কারী

  ৭. বুখারী শরীফ- অনুবাদ : শাইখুল হাদীস আজিজুল হক

  ৮. তাফসীরে ইবনু জারির তাবারী- ইবনে জারীর তাবারী

  ৯. তাফসীরে দুররুল মানসুর- জালালুদ্দীন সুয়ূতী

  ১০. মা সাবাতা মিনাস্ সুন্নাহ- আবদুল হক মুহাদ্দেসে দেহলভী

  ১১. সিরাতে ইবনে হিশাম- ইবনে হিশাম কোরেশী

  ১২. সিরাতুন্নবী- শিবলী নোমানী

  ১৩. বিশ্বনবী- কবি গোলাম মোস্তফা

  ১৪. গুলিস্তানে সাদী- শেখ সাদী

  ১৫. কুল্লিয়াতে ইকবাল- ড. ইকবাল

  ১৬. নজরুলের ইসলামী সংগীত- নজরুল ইসলাম

  ১৭. সিরাজাম মুনীরা- কবি ফররুখ আহমদ

  ১৮. আল মাহমুদের কবিতা- কবি আল মাহমুদ

  ১৯. দিওয়ানে হাসসান বিন সাবিত- কবি হাসসান বিন সাবিত

  ২০. নাহজুল বালাগা- হযরত আলী (রা.)

  ২১. মুফরাদাতে ইমাম রাগেব- ইমাম রাগেব

  ২২. আল মুনজিদ

  ২৩. গিয়াসুল লোগাত

  ২৪. লোগাতে কিশওয়ারী

  ২৫. ফারহাঙ্গে জবানে ফারসি- মুশীদ মুসাইয়েরী

  ২৬. কাসিদায়ে গাউসুল আজম- বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)

  ২৭. কাসিদায়ে বোরদা- আল্লামা বুছিরী

  ২৮. শরহে বুখারী যোরকানী- আল্লামা যুরকানী

  ২৯. নেহায়াতুল আরব- আল্লামা নুবাইরী