‘কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করে’- [সূরা নিসা : আয়াত-৮০]। অতএব রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে আল্লাহর প্রতিই সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
ঈদে মিলাদুন্নবীতে ভাসানী হুজুরতার ভক্ত-অনুসারীদের নিয়ে নিজেই মিলাদ পাঠ করতেন। আমরা যারা তার সঙ্গে ছিলাম, সবাই মিলাদ মাহফিলে শরিক হতাম। নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য মিলাদ মাহফিলে হুজুর ভাসানী কিয়াম করতেন। আমরাও তার সঙ্গে কিয়াম করতাম।
কিয়াম অর্থ আদব বা সম্মান রক্ষার্থে দাঁড়ানো। এ আদব রক্ষা করা ইবাদতের অংশ প্রেমিকদের জন্য। হুজুর ভাসানী বলতেন, নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি যারা এ আদব রক্ষা করবে না তারা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত থাকবে।
নূরে মোহাম্মদীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য হজরত আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করতে হুকুম দিলেন আল্লাহ পাক। সব ফেরেশতা সিজদা করলেন আদমকে আলাইহিস সালামকে। কিন্তু ইবলিশ আপত্তি উত্থাপন করে বলল, আমি আগুনের তৈরি এবং তার চেয়ে উত্তম। অতএব আমি সিজদা করব না। দুর্ভাগা ইবলিশ শয়তান বুঝল না যে, এটা না করে সে স্বয়ং আল্লাহর হুকুমকে অমান্য করল। আল্লাহ যে মাটির আদমের ভেতরে নূরে মোহাম্মাদীর নূরকে অনুপ্রবেশ করিয়েছেন এটা সে বুঝতে পারল না। সে পথভ্রষ্ট ও আল্লাহতায়ালার অভিশাপে অভিশপ্ত হল। এ কারণে শয়তান যুক্তি ও কূট তর্কের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে বদ্ধপরিকর হয়।
ভাসানী হুজুর বলেন, নবী-বিদ্বেষীদের শত ইবাদতও কোনো কাজে আসবে না। ওরা আল্লাহর সহজ-সরল, সত্য-সুন্দর পথকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখবে। কারণ ওদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন," তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বৃদ্ধি করেছেন ও তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাচারী [সূরা বাকারা, আয়াত : ১০]।
হুজুর ভাসানী আরও বলেছেন, নবী বিদ্বেষের মহাব্যাধি যার হৃয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে- সে অন্ধকারের ভয়াবহ অতল গহ্বরে পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ ইবলিশ শয়তান। সে আদব নষ্ট করে বেয়াদবের খাতায় নাম লিখিয়ে চিরতরে জাহান্নামি হয়ে গেছে।
অতএব যারা নবীর প্রতি আদব রক্ষা করে চলবেন তারা থাকবেন ফেরেশতাদের কাতারে। আর যারা তা রক্ষা করবে না তারা থাকবে ইবলিশের কাতারে।
এ প্রসঙ্গে আল্লামা রুমী বলেন :
‘আয় খোদা খাহিমে তাওফিকে আদব
বেয়াদব মাহ্রুম মানাদ আয লুতফে রব।’
অর্থাৎ : ‘হে খোদা! আমাকে আদব রক্ষা করার তাওফিক দাও। কারণ বেয়াদব আল্লাহর করুণা থেকে বঞ্চিত থাকে।’
মদিনার আউস গোত্রের সর্দার ছিলেন হজরত সাআদ বিন মুয়াজ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। বনু কোরাইযার যুদ্ধে হজরত সাআদ রদ্কেবিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে তারা সালিশি মানে। যে কারণে উনাকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডেকে পাঠান। হজরত সাআদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন মসজিদের সামনে এসে পৌঁছলেন, তখন হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসার সাহাবিদের নির্দেশ দিলেন " সর্দারের প্রতি সম্মানার্থে সবাই দাঁড়িয়ে যান।" নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এ কথায় উপস্থিত সাহাবিরা দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান দেখান। তাকে সওয়ারি থেকে তারা নামিয়ে আনেন [বোখারি শরিফ] এটা ছিল একজন সর্দারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কিয়াম।
আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক উভয় দিক দিয়ে নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সঠিকভাবে জানতে হুজুর আল্লামা দার্শনিক কবি ইকবাল নবী (সা.) সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন-
‘আবদু দিগার আবদুহু চিজে দিগার।
ই-ছেরাপাঁ এন্তেজার উঁ মুন্তাজার।
অর্থাৎ ‘আবদুন’ এক জিনিস আর ‘আবদুহু’ অন্য জিনিস। আল্লাহকে রাজি বা সন্তুষ্ট করানোর জন্য যিনি ব্যস্ত থাকেন তিনি আবদুন, আর যাকে রাজি বা সন্তুষ্ট করানোর জন্য স্বয়ং আল্লাহ ব্যস্ত থাকেন তিনি আবদুহু [সোবহানাল্লাহ] এতে বুঝা যায় সব মোমিন ‘আবদুন’, আর নবীয়েদোজাহাঁ শাফিয়ে মজরেমা হলেন, ‘আবদুহু’। যেমন কলেমায় বলা হয়েছে- আবদুহু ওয়ারাসূলুহু। কোরআন পাকে বলা হয়েছে- আসরা বিআবদিহি। সুতরাং যারা মাওলানা হয়েছেন, মুফতির সাইন বোর্ড লাগিয়েছেন, চিন্তাবিদ মুসলিম দার্শনিক নাম ধারণ করে কোরআন হাদিসের মুখপাত্র হয়েছেন, কিন্তু আবদুন আর আবদুহুর পার্থক্য করতে পারেননি এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে? তাদের মুসলিম দার্শনিক আল্লামা কবি ইকবালের বই পড়তে সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।
নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মর্যাদা ও মর্তবা সম্পর্কে আল্লামা ইকবাল
আরও বলেন :
‘আবদুহু দাহরাস্ত দাহরাস্ত আবদুহু/ মাহুমা রংগিমে দাদরে রংগে বু॥/ আবদুহু চান্দ ও চেগুনে কায়েনাত।/ আবদুহু রাজে দারুণে কায়েনাত॥/ কাসযা সিররি আবদুহু আগাহে নিস্ত।/ আবদুহু জুয্ সিররি ইল্লাল্লাহ্ নিস্ত॥/ আবদুহু সুরতে গার তাকদিরে হাস্ত।/ আন্দার-ই-তাখরিবে হাতামিরে হাস্ত।/ মদয়ী পয়দা নাহ্গার দোজি দোবায়াত।/ তানাহ্ বীনি আয মাকামে মা রামায়াত॥’
অর্থাৎ : জামানা হল ‘আবদুহু’, আর ‘আবদুহু’ থেকেই জামানার অস্তিত্ব। আমরা সব সৃষ্টি ভিন্ন রং ও বর্ণের। কিন্তু আবদুহু অর্থাৎ মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া লিহি ওয়া সাল্লাম সব কিছুর ঊর্ধ্বে। সৃষ্টির সব কিছুই আবদুহু। আর আবদুহু গোটা জাহানের গুপ্ত ভেদ। কেউই আবদুহুর গোপন ভেদ তত্ত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। কেননা আবদুহু তো ইল্লাল্লাহুর গুপ্ত ভেদ ছাড়া আর কিছুই নয়। আবদুহু সব তকদিরের ছবি অংকনকারী। আর এর সারমর্ম অনুধাবন করতে পারবে না, যতক্ষণ তুমি মাকামে ‘মা, রামাইয়াতা’ অবলোকন না করবে। [শানে হাবীবুর রহমান পৃঃ ১১৩]।
আল্লামা রুমী বলেন :
কারে পাকা বা কেয়াস আজ খোদ মাগির।/গারচেহ মানাদ দার নাবিশতান শেরও শির॥/ শির আবাশাদ কেহ্ মরদাম মী দারাদ।
শের আ বাশাদ কেহ মরদাম্ মী খোরাদ॥
অর্থাৎ ফার্সি ভাষায় শের ও শির একই রকমে ও একই হরফে লেখা কিন্তু অর্থ ভিন্ন। শির অর্থ দুধ, যা মানুষে পান করে। আর শের অর্থ বাঘ, যে মানুষকে খায়। যদিও তার একই বানান, কিন্তু উচ্চারণে ও অর্থে পার্থক্য আসমান আর জমিন। আমরাও বান্দা, নবীও বান্দা, কিন্তু বোধশক্তি সম্পন্ন মানুষের জন্য এতে ব্যবধান রয়েছে আসমান ও জমিন অথবা তার চেয়েও বেশি। [দেখুন, জিকরে জামিল- পৃ. ২৯৬, মাকামে নবুয়ত পৃ. ৬১]
মওলানা জালাল উদ্দিন রুমী আরও বলেন,
হামসেরি বা আম্বিয়া বর দাশতান্দ
আউলিয়ারা হাম চুঁ খোদ পান দাশতান্দ॥
অর্থাৎ নিজেদের ভুল ধারণাবশত কখনও তারা সম্মানিত নবীকে নিজেদের মতো মানুষ মনে করে। আবার কখনও নিজেদের আউলিয়াদের সমকক্ষ মনে করে।
আশকিয়ারা দিদায়ে বীনা নাবুদ,
নেক ও বদদর দিদাহ্ শাহ্ একসাঁ নামুদ।
অর্থাৎ বদবখত লোকেরা সত্য দেখা থেকে বঞ্চিত থাকে। এ জন্য তাদের চোখে ভালো-মন্দ একই রকম অনুভব হয়। নবী বিদ্বেষ অন্তরে থাকার কারণে তাদের বিবেক-বুদ্ধি নষ্ট হয়ে যায়। এরা সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করতে পারে না। দেখুন- জিকরে জামিল পৃ. ২৯৭, মাকতুবাত শরিফ উর্দু ২য় খণ্ড পৃ. ১৫০]।
‘গোফতে ইনাকমা বাশার ঈশা বাশার,
মা ও ঈশা বোস্তানে খাঁ বীমত্ত খোর’।
অর্থাৎ বেকুবেরা বুঝে না, তারা বলে আমরাও মানুষ, তিনিও মানুষ। আমরাও খাই, ঘুমাই তিনিও খান, ঘুমান, তবে পার্থক্য কোথায়? রাসূলের ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সঙ্গে সৃষ্টি জগতের কারও তুলনা হতে পারে না। রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন অতুলনীয়। নবী হজরত মুহাম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর মাধ্যম ছাড়া আল্লাহকে পাওয়া যাবে না। নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে গণ্য না করলে কখনও মুমিন মুসলিম হওয়া যাবে না। পবিত্র কোরআন পাকে বলা হয়েছে :
‘হে মুহাম্মদ! আপনার রবের শপথ। তারা কখনও মুমিন নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না পারস্পরিক বিরোধ-মীমাংসার ক্ষেত্রে আপনাকে চূড়ান্ত ফয়সালাকারী হাকিম হিসেবে মেনে না নেয় এবং পূর্ণ আত্বসমর্পন মানসিকতা নিয়ে নিঃসংকোচে আপনার ফয়সালাকে গ্রহণ না করে’। [দেখুন, সূরা নিসা, আয়াত-৬৫]। এতে নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে নিঃশর্ত নিঃসংকোচ আÍসমর্পণকেই আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা হল বলে চূড়ান্তভাবে
স্বীকৃত হল।
লেখক : হুজুর ভাসানী এর স্নেহধন্য, মওলানা ভাসানী আদর্শ অনুশীলন পরিষদের সভাপতি ও গবেষক।