সুরা ইবরাহীম শরীফ উনার দ্বারা ঈদে মিলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রমানিত

কিছুদিন পূর্বে ফকেহানী ফেরকার অনুসারী হারামে মশগূল এক বিদ‘য়াতী, বদচরিত্র, নামধারী মুফতি পবিত্র ঈদে মীলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে আলোচনায় বলে যে, পবিত্র কুরআন শরীফে বর্ণিত সূরা ইবরাহীম-এর ৫ নং আয়াত শরীফে বর্ণিত ঘটনা শুধুমাত্র হযরত মূসা আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমের জন্য খাছ। এই ঘটনাটি থেকে উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনভাবেই পবিত্র ঈদে মীলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালনের দলীল উপস্থাপন করতে পারেন না।
এ বক্তব্য তার ইলমের দৌড়কে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে।
কেননা সূরা ইবরাহীম শরীফ উনার ৫ নং আয়াত শরীফে বর্ণিত ঘটনা শুধুমাত্র হযরত মূসা আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমের জন্য যদি খাছ হয় তাহলে পবিত্র কুরআন শরীফে এই আয়াত শরীফ নাযিলের প্রয়োজনীয়তাই কি ছিল? পবিত্র কুরআন শরীফে তো পূর্ববর্তী ক্বওমের বর্ণনা সম্বলিত এমন অনেক আয়াত শরীফ রয়েছে। সে ঘটনাগুলো কি শুধুমাত্র তিলাওয়াত করা জন্যই নাযিল হয়েছে? নাকি উক্ত ঘটনা থেকে উপদেশ গ্রহণের জন্য নাযিল হয়েছে?
পূর্ববর্তী ক্বওমের বর্ণনা সম্বলিত আয়াত শরীফগুলো যে উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক উপদেশ গ্রহণের জন্য নাযিল হয়ে সেটা পবিত্র কুরআন শরীফেই বলে দেয়া হয়েছে।
যেমন- সূরা ইউসূফ : ১১১, সূরা হূদ : ১২০
لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ ۗ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَىٰ وَلَـٰكِن تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ كُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
অর্থ: উনাদের কাহিনীতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে শিক্ষণীয় বিষয়, এটা কোন মনগড়া কথা নয়, কিন্তু যারা বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্যে পূর্বেকার কালামের সমর্থন এবং প্রত্যেক বস্তুর বিবরণ, রহমত ও হিদায়াত। (সূরা ইঊসুফ : ১১১)
وَكُلًّا نَّقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنبَاءِ الرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِ فُؤَادَكَ ۚ وَجَاءَكَ فِي هَـٰذِهِ الْحَقُّ وَمَوْعِظَةٌ وَذِكْرَىٰ لِلْمُؤْمِنِينَ
অর্থ: আর আমি রসূলগণের সব বৃত্তান্তই আপনাকে বলছি, যা দ্বারা আপনার অন্তর মজবুত করছি। আর এভাবে আপনার নিকট মহাসত্য এবং ঈমানদারদের জন্য নসীহত ও স্মরণীয় বিষয়বস্তু এসেছে। (সূরা হূদ : ১২০)
এই আয়াত শরীফের (সূরা হূদ : ১২০) তাফসীরে বর্ণিত রয়েছে-
وهذه الحكمة في قصص الأولين علينا لنعتبر بها. (تفسير البحر المحيط تفسير رقم الاية ۱۲۰ من سورة هود شريف اسم المؤلف: محمد بن يوسف بن على ابو حيان النحوى الاندلسى رحمة الله عليه تاريخ الوفاة ۷۴۵ هجرى)

অর্থ: “পূর্ববর্তীদের ঘটনাসমূহে আমাদের জন্য এই হিকমত রয়েছে যে, আমাদের জন্য পূর্ববর্তী ঘটনাসমূহ হতে উপদেশ গ্রহণ করা দায়িত্ব-কর্তব্য।” (তাফসীরুল বাহরুর মুহীত)
এছাড়াও সূরা আহযাব শরীফ উনার ৫৬ নং আয়াত শরীফের তাফসীরে মুফাসসির হযরত মুহম্মদ ইবনে আলী ছাবূনী রহমতুল্লাহি আলাইহি (বিলাদত: ৬০৪ হিজরী, ওফাত: ৬৮০ হিজরী) তিনি বর্ণনা করেন-
اقول: كل ما ورد فى القران من خطاب للنبى او الرسول فانما يقصد به محمد عليه الصلاة والسلام خاتم الانبياء والمرسلين صلوات الله عليهم اجمعين. (روائع البيان فى تفسير ايات الاحكام تفسير رقم الاية ۵۶ من سورة الاحزاب شريف المؤلف: محمد بن على بن محمود بن احمد الصابونى الحافظ جمال الدين المحمودى الدمشقى المعروف بابن الصابونى سنة الولادة ۶۰۴ هجرى وسنة الوفاة ۶۸۰ هجرى)
অর্থ: “(হযরত মুহম্মদ ইবনে আলী ছাবূনী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন) আমি বলি: পবিত্র কুরআন মাজীদ উনার মধ্যে হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে সম্মোধন করে যা কিছু বর্ণিত আছে, তা দ্বারা মূলতঃ খাতামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে।” সুবহানাল্লাহ! (রওয়ায়িউল বায়ান ফী তাফসীরি আয়াতিল আহকাম)
সুতরাং দেখা গেল যে, সূরা ইবরাহীম শরীফ উনার ৫ নং আয়াত শরীফে বর্ণিত ঘটনা শুধুমাত্র হযরত মূসা আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমের জন্য খাছ নয়।
এখন আসা যাক, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমের ঘটনাটি থেকে পবিত্র ঈদে মীলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালনের দলীল উপস্থাপন করা যায় কিনা?
সূরা ইবরাহীম শরীফ উনার ৫ নং আয়াত শরীফে বর্ণিত-
ذَكِّرْهُم بِأَيَّامِ اللهِ
এর তাফসীরে হযরতুল আল্লামা ক্বাযী মুহম্মদ ছানাউল্লাহ উছমানী হানাফী মাতুরীদী মাযহারী নকশবন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি (বিলাদত: ১১৪৩ হিজরী, ওফাত: ১২২৫ হিজরী) ‘তাফসীরুল মাযহারী’ ৫ম খণ্ড ১১৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
(وذكرهم بايام الله) قال ابن عباس رضى الله تعالى عنه وابى بن كعب رضى الله عنه ومجاهد رحمة الله عليه وقتادة رحمة الله عليه بنعم الله
অর্থ: “(মহান আল্লাহ পাক উনার বিশেষ বিশেষ রাত, দিন ও সময়সমূহের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিন) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত উবাই ইবনে কা’ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত মুজাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত ক্বতাদাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা ‘ايام الله’ র অর্থ করেছেন ‘মহান আল্লাহ পাক উনার নিয়ামতসমূহ, হিসেবে।”
খাতিমাতুল মুহাক্কিক্বীন, উমদাতুল মুদাক্কিক্বীন, মুফতীয়ে বাগদাদ, আল্লামা আবুল ফদ্বল শিহাবুদ্দীন সাইয়্যিদ মাহমূদ আলূসী বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি (ওফাত: ১২৭০ হিজরী) উনার লেখা ‘রূহুল মায়ানী ফী তাফসীরিল কুরআনিল আযীম ওয়াস সাবয়িল মাছানী’ কিতাবে ‘সূরা ইবরাহীম শরীফ উনার ৫ নং পবিত্র আয়াত শরীফের তাফসীরে উল্লেখ আছে-
(وذكرهم بايام الله) اى بنعمائه وبلائه كما روى عن ابن عباس رضى الله تعالى عنهما، وحاصل الـمعنى بالترغيب والترهيب والوعد والوعيد. وعن حضرت ابن عباس رضى الله تعالى عنهما ايضا والربيع رحمة الله عليه ومقاتل رحمة الله عليه وابن زيد رحمة الله عليه الـمراد بايام الله وقائعه سبحانه ونقماته فى الامم الخالية، ومن ذلك ايام العرب لحروبـها وملاحمها كيوم ذى قار ويوم الفجار ويوم قضة وغيرهما. واستظهره الزمخشرى رحمة الله عليه للغلبة العرفية وان العرب استعملته للوقائع، وانشد الطبرسى لذلك قول عمرو بن كلثوم:
وايام لنا غرر طوال: عصينا الـملك فيها ان ندينا
وانشده الشهاب للمعنى السابق، وانشد لهذا قوله: وايامنا مشهورة فى عدونا.
واخرج النسائى عبد الله بن احمد رحمة الله عليه فى زوائد الـمسند والبيهقى فى شعب الايـمان وغيرهم عن ابى بن كعب رضى الله عنه عن النبى صلى الله عليه وسلم انه فسر الايام فى الاية بنعم الله تعالى والائه، وروى ذلك ابن الـمنذر رحمة الله عليه عن ابن عباس رضى الله عنه ومجاهد رحمة الله عليه، وانت تعلم انه ان صح الحديث فعليه الفتاوى.
অর্থ: (মহান আল্লাহ পাক উনার বিশেষ বিশেষ রাত, দিন ও সময়সমূহের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিন) অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার নিয়ামতসমূহ ও উনার কর্তৃক নাযিলকৃত বালা-মুছীবত সমূহের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিন। যা বর্ণনা করেছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা তিনি। মূল মর্মার্থ হলো- আপনি তাদেরকে উপদেশ, ভীতি প্রদর্শন দ্বারা এবং কৃত অঙ্গিকার ও শাস্তির অঙ্গিকারের কথা স্মরণ করিয়ে নছীহত মুবারক করুন। ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা, হযরত রবী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত মুক্বাতিল রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত ইবনু যায়েদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, ايام الله দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- মহান আল্লাহ সুবহানাহু উনার পক্ষ থেকে বান্দাদের প্রতি বিশেষ স্বরণীয় ঘটনাসমূহ এবং পূর্ববর্তী জাতিদের শাস্তি, প্রতিশোধ, ঘাত প্রতিঘাত ইত্যাদি অবস্থাদী। এ ছাড়াও এর দ্বারা আরবদের যুদ্ধ বিগ্রহ, হত্যা খুন-খারাবীর ইতিহাস যেমন: ‘ইয়াওমুল যী কার,’ ‘ইয়াওমুল ফুজ্জার, ‘ইয়াওমে ক্বাদ্বাহ’ ও এ ছাড়া অন্যান্য বিশেষ ঘটনাবহুল দিবসকে স্মরণ করতে বলা হয়েছে। আল্লামা যামাখশারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি প্রাধান্যপ্রাপ্ত মর্মার্থের ব্যাপারে মত প্রকাশ করে বলেন, আরবরা ايام الله উনার অর্থ করে থাকেন- ঘটনা ও ইতিহাস হিসেবে। যেমনটি ত্ববারাসী তিনি আমর বিন কুলছূম-এর কবিতা আবৃতি করে উদাহরণ পেশ করেন।
(কবিতা) : ‘ঘটনাবহুল দুর্যোগময় সময়গুলো আমাদের জন্য লম্বা হয়েছে।’
এই একই অর্থে কবিতা আবৃতি করেছেন আল্লামা শিহাব রহমতুল্লাহি আলাইহি। যেমনটি তিনি বলেন: (কবিতা): ‘আমাদের মুসলমানগণের বিজয়ের ঘটনাবহুল দিনগুলো আমাদের শত্রুদের কাছে আতঙ্কের।’
হযরত ইমাম নাসায়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ‘নাসায়ী শরীফ-এ’, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ‘যাওয়ায়িদুল মুসনাদ’ কিতাবে, হযরত ইমাম বাইহাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ‘শুয়াবুল ঈমান’ কিতাবে এবং অন্যান্যগণ হযরত উবাই ইবনে কা’ব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার থেকে বর্ণনা করেন, তিনি নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে বর্ণনা করেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ايام শব্দের তাফসীরে ইরশাদ করেন তা হচ্ছে- মহান আল্লাহ পাক উনার কর্তৃক বান্দার প্রতি প্রদত্ত নিয়ামত, দয়া, দান, অনুগ্রহ, কল্যানসমূহ। যা হযরত ইবনুল মুনযির রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত মুজাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে বর্ণনা করেছেন।”
অন্যান্য তাফসীরেও ذَكِّرْهُم بِأَيَّامِ اللهِ মহান আল্লাহ পাক উনার কর্তৃক বান্দার প্রতি প্রদত্ত নিয়ামত, দয়া, দান, অনুগ্রহ, কল্যানসমূহ বুঝানো হয়েছে।
এছাড়াও সূরা ইবরাহীম শরীফ উনার ৫ নং আয়াত শরীফের শেষাংশে إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ এর ব্যাখ্যায় তাফসীরুল কুরতুবী তে উল্লেখ আছে,
(إِنَّ فِي ذلِكَ) أي في التذكير بأيام الله (لَآياتٍ) أي دلالات. (لِكُلِّ صَبَّارٍ) أي كثير الصبر على طاعة الله وعن معاصيه. (شَكُورٍ) لنعم الله. وقال قتادة: هو العبد، إذا أعطي شكر، وإذا ابتلي صبر. وروى عن النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أنه قال:" الإيمان نصفان نصف صبر ونصف شكر- ثم تلا هذه الآية-" إِنَّ فِي ذلِكَ لَآياتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ". ونحوه عن الشعبي موقوفا. وتواري الحسن البصري عن الحجاج سبع سنين، فلما بلغه موته قال: اللهم قد أمته فأمت سنته، وسجد شكرا، وقرا:" إِنَّ فِي ذلِكَ لَآياتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ". وإنما خص بالآيات كل صبار شكور، لأنه يعتبر بها ولا يغفل عنها، كما قال:" إِنَّما أَنْتَ مُنْذِرُ مَنْ يَخْشاها" «2» [النازعات: 45] وإن كان منذرا للجميع. (الجامع لاحكام القران للقرطبي اى تفسير القرطبي المؤلف: ابو عبد الله محمد بن احمد بن ابي بكر بن فرح الانصاري الخزرجي شمس الدين القرطبي رحمة الله عليه المتوفى ۶۷۱ هجري سورة ابراهيم شريف رقم الاية ۵)
অর্থ : “(নিশ্চয়ই এতে রয়েছে) বিশেষ দিনসমূহ আলোচনা বা পালন করার মধ্যে রয়েছে (উপদেশসমূহ) নিদর্শনাবলী (প্রত্যেক পরম ধৈর্যশীল) মহান আল্লাহ তায়ালা উনার আনুগত্য করণ ও গুনাহ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে অসীম ধৈর্য্যধারণকারী (ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য) মহান আল্লাহ তায়ালা উনার থেকে প্রদত্ত নিয়ামত প্রাপ্তির জন্য। হযরত ক্বতাদাহ্ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন: তিনি এমন বান্দা, যখন উনাকে কিছু নিয়ামত দেয়া হয় তখন শুকরিয়া আদায় করে, আর তার উপর বিপদ আসে তখন ধৈর্যধারণ করে। নিশ্চয়ই নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন: পবিত্র ঈমান উনার দুইটি দিক আছে। অর্ধেক হলো ধৈর্য্য ধারণ করা, আর অপর অর্ধেক হলো শুকরিয়া জ্ঞাপন করা। অতঃপর তিনি অত্র পবিত্র আয়াত শরীফ উনাকে তিলাওয়াত করেন ‘এতে নিদর্শন মুবারক ও উপদেশ রয়েছে প্রত্যেক পরম ধৈর্য্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য’। অনুরূপ বর্ণনা হযরত ইমাম শা’বী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকেও মাওকূফ সূত্রে বর্ণিত আছে। হযরত ইমাম হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হিজায অঞ্চলে সাত বছর নিরিবিলি অবস্থান করেছিলেন। যখন উনার মাউতের সময় হলো তখন তিনি প্রার্থনা করছিলেন এভাবে যে: আয় মহান আল্লাহ তায়ালা! আমি তো ইন্তিকাল বরণ করছি, তাই আমার মউত সুন্নত উনার তরীকায় হয়। এবং তিনি দুয়া’র মধ্যেই অত্র আয়াত শরীফ পাঠ করছিলেন ‘এতে নিদর্শন মুবারক ও উপদেশ রয়েছে প্রত্যেক পরম ধৈর্য্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য’। নিশ্চয়ই পবিত্র অত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে প্রত্যেক ছবরকারী ও শুকরগুজার বান্দাহ উনাদেরকে খাছ করা হয়েছে। যাতে ব্যক্তি এ (বিশেষ বিশেষ দিন রাত পালন করার মাধ্যমে ছবর ও শুক্র আদায় করা) থেকে নছীহত অর্জন করে, আর এ থেকে গাফিল বা অমনোযোগী না হয়। যেমনটি মহান আল্লাহ তায়ালা তিনি পবিত্র সূরাতুন নাযিয়াত উনার ৪৫ নম্বর পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন: নিশ্চয়ই আপনি ভীতিপ্রদর্শনকারী উনাদের জন্য, যাঁরা আপনাকে ভয় করে থাকে। যদিও তিনি সর্বশ্রেণী ব্যক্তিদেরকে ভীতিপ্রর্দনকারী।” (আল্ জামি’ লি আহকামিল কুরআন লিল্ কুরতুবী)
হযরতুল আল্লামা ক্বাযী মুহম্মদ ছানাউল্লাহ উছমানী হানাফী মাতুরীদী মাযহারী নকশবন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি (বিলাদত: ১১৪৩ হিজরী, ওফাত: ১২২৫ হিজরী) ‘তাফসীরুল মাযহারী’ ৫ম খণ্ড ১১৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
(ان فى ذلك) الوقائع (لايات) على وجود الصانع وعلمه وقدرته حكمته ووحدته (لكل صبار) يصبر كثيرا على البلاء والطاعة عن الـمعصية. (شكور) يشكر كثيرا على نعمائه والـمراد به لكل مؤمن.
অর্থ “(নিশ্চয়ই এতে রয়েছে) অতীতের ঘটনাসমূহে রয়েছে (উপদেশসমূহ) ওই সকল ঘটনাবলীর মধ্যে রয়েছে মহান আল্লাহ পাক উনার এককত্ব ও শক্তিমত্তার আশ্চর্য নিদর্শন ও হিকমত। (প্রত্যেক পরম ধৈর্যশীল) যারা বালা-মুছীবতের সময় ছবর করেন (ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য) যাঁরা নিয়ামতসমূহ পাওয়ার কারণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। উনার দ্বারা উদ্দেশ্য প্রত্যেক মু’মিন-মুসলমানগণ।”
সুতরাং অতীতের ঘটনাসমূহের মধ্যে প্রত্যেক মু’মিন-মুসলমানগণের জন্য উপদেশ রয়েছে। আলাদাভাবে শুধুমাত্র বনী ইসরাঈলের জন্য নয়। কোন তাফসীরকারক বলেননি যে, শুধুমাত্র বনী ইসরাঈলই উপদেশ গ্রহণ করবে পরবর্তীতে যারা আসবেন উনারা উক্ত ঘটনা থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে পারবেন না।
সর্বোপরি, সূরা ইবরাহীম শরীফ শুরুই হয়েছে রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সম্মোধন করে। প্রথম আয়াত শরীফ যখন বর্ণনা হয়েছে তখন সেখানে ‘ক্বওম’ শব্দের পরিবর্তে ‘নাস’ মানবমন্ডলী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
সুতরাং সূরা ইবরাহীম শরীফ উনার ৫ নং আয়াত শরীফ দ্বারা শুধুমাত্র বনী ইসরাঈলকেই খাছ করা হয়নি বরং পরবর্তী উম্মত- উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের জন্যও উপদেশ গ্রহণের বিষয় রয়েছে। 
পূর্ববর্তীদের ঘটনা পরবর্তীদের জন্য ইবরত নছীহতের এই বিষয়টা জাহিলরা জানে না। যা প্রকৃতপক্ষে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার সূরা ইউসূফ শরীফ, ১১১ নং আয়াত শরীফ, সূরা হূদ শরীফ, ১২০ নং আয়াত শরীফ অস্বীকার করার নামান্তর।
যেহেতু সূরা ইবরাহীম শরীফ উনার ৫ নং আয়াত শরীফে মহান আল্লাহ পাক উনার বিশেষ বিশেষ দিন সমূহ স্মরণ করতে বলেছেন এবং এর তাফসীরে তাফসীরকারকগণ মহান আল্লাহ পাক প্রদত্ত নিয়ামত সমূহ স্মরণের কথা বলেছেন। আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সমগ্র জাহানের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। তাই উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের জন্য নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে পাওয়ার কারণে পবিত্র ১২ই রবী‘উল আউওয়াল শরীফ হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত প্রাপ্তির দিবস। যা উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের জন্য উদযাপন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয।
সুতরাং সূরা ইবরাহীম-এর ৫ নং আয়াত শরীফে বর্ণিত ঘটনাটি থেকে উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত দৃঢ়ভাবেই পবিত্র ঈদে মীলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালনের দলীল উপস্থাপন করতে পারেন।
মূলত তাফসীরের উছূল সম্পর্কে নেহায়েতই অজ্ঞ হওয়ার কারণেই উক্ত নামধারী মুফতি এ ধরনের মূর্খতা সূচক বক্তব্য প্রদান করেছে। অথচ অথচ বর্ণিত আছে, ছহাবী হযরত আবূ দারদা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনি বলেছেন:
اشار ابو الدرداء رضى الله عنه حيث قال: لا يكون الرجل فقيها حتى يحمل الاية الواحدة على محامل متعددة. (الفوز الكبير الباب الثانى الفصل الثالث المؤلف: الامام حضرت احمد بن عبد الرحيم المعروف: شاه ولى الله المحدث الدهلوى الحنفى الماتريدى رحمة الله عليه الولادة ۱۱۱۴ هجرى والوفاة ۱۱۷۶ هجرى)
অর্থ: একই পবিত্র আয়াত শরীফ বহুসংখ্যক স্থানে প্রয়োগ করতে সক্ষম না হলে কেউ ফকীহ হতে পারবে না। (আল-ফাওযুল কবীর অধ্যায়: ২য় পরিচ্ছেদ: ৩য় লেখক: ইমাম হযরত আহমদ বিন আব্দুল রহীম শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী হানাফী মাতুরীদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বিলাদত: ১১১৪ হিজরী ওয়াফাত: ১১৭৪ হিজরী, ইবনে সা’দ, ইবনে আসাকীর)

এছাড়াও বনী ইসরাঈলের আশুরার দিনে রোযা রাখার হাদীছ শরীফ দ্বারা ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি পবিত্র ঈদে মীলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালনের দলীল উপস্থাপন করেছেন।
যেমন হাভী লিল ফতওয়াতে উল্লেখ আছে-
وقد سئل شيخ الإسلام حافظ العصر أبو الفضل أحمد بن حجر عن عمل المولد فأجاب بما نصه : أصل عمل المولد بدعة لم تنقل عن أحد من السلف الصالح من القرون الثلاثة ولكنها مع ذلك قد اشتملت على محاسن وضدها ، فمن تحرى في عملها المحاسن وتجنب ضدها كان بدعة حسنة وإلا فلا ، قال : وقد ظهر لي تخريجها على أصل ثابت وهو ما ثبت في الصحيحين من أن النبي صلى الله عليه وسلّم قدم المدينة فوجد اليهود يصومون يوم عاشوراء فسألهم فقالوا هو يوم أغرق الله فيه فرعون ونجى موسى فنحن نصومه شكراً لله تعالى ، فيستفاد منه فعل الشكر لله على ما من به في يوم معين من إسداء نعمة أو دفع نقمة ، ويعاد ذلك في نظير ذلك اليوم من كل سنة ، والشكر لله يحصل بأنواع العبادة كالسجود والصيام والصدقة والتلاوة ، وأي نعمة أعظم من النعمة ببروز هذا النبي نبي الرحمة في ذلك اليوم ، وعلى هذا فينبغي أن يتحرى اليوم بعينه حتى يطابق قصة موسى في يوم عاشوراء ، ومن لم يلاحظ ذلك لا يبالي بعمل المولد في أي يوم من الشهر ، بل توسع قوم فنقلوه إلى يوم من السنة وفيه ما فيه ، فهذا ما يتعلق بأصل عمله . (الحاوى للفتاوى فى الفقه وعلوم التفسير والحديث والاصول والنحو والاعراب وسائر الفنون كتاب الصداق باب الوليمة ۲۴- حسن المقصد فى عمل المولد الجزء ۱ الصفحة ۱۹۶ دار الكتب العلمية بيروت لبنان وقت النشر: ۱۴۰۸ هجرى مع ۱۹۸۸ عيسائى)
অর্থ: শাইখুল ইসলাম, হাফিযুল আছর, আবুল ফযল আহমদ বিন হাজার রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে মাওলূদ শরীফ উনার আমল ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো। নছ উনার ভিত্তিতে তিনি জাওয়াবে বলেন: মাওলূদ শরীফ উনার আমল করা বিদয়াত। কারণ, প্রথম তিন যুগের সলফে ছালিহীন রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের কেউই এ ব্যাপারে কোনো বর্ণনা করেননি। তবে এতে কিছু ভালো ও মন্দ কাজের মিশ্রণ আছে। সুতরাং যদি মন্দ ছেড়ে ভালো এর উপর আমল করা হয়, তবে এটা বিদয়াতে হাসানাহ্ হবে। নতুবা হাসানাহ্ হবে না। তিনি বলেন- আমার মতে অনুষ্ঠানের আমল বা মূল আছে বা বুখারী/মুসলিম শরীফে আছে যে, নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় তাশরীফ নিলেন তখন দেখতে পেলেন যে, ইয়াহূদীরা আশূরার দিন রোযা রাখে। নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাস করলেন, তোমরা কেন রোজা রাখছো? তারা উত্তরে বললো: ঐ দিন মহান আল্লাহ তায়ালা ফিরাঊনকে ডুবিয়ে ছিলেন এবং হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে নাজাত দিয়েছিলেন। তাই আমরা এর শুকরিয়া স্বরূপ রোজা রাখি। আর এ থেকে মহান আল্লাহ তায়ালা উনার শুকরিয়া স্বরূপ ২ দিন রোজা রাখার প্রচলন করেছিলেন। আর এটা প্রতি বছর করতেন। আর মহান আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া বিভিন্নভাবে হয়, যেমন- সিজদাহ্ করে, রোযা, ছদাক্বা ও তিলাওয়াত দ্বারা। সুতরাং বলা হয়- নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আবির্ভাব একটা বড় নিয়ামত এর চেয়ে বড় কোনো নিয়ামত পৃথিবীতে নেই। সুতরাং বলা যায়- উচিৎ হলো একটি নির্দিষ্ট দিন বের করা যেখানে আশূরার মতো হয়। আর এটাকে একটি আছল বলা হয়। (আল-হাবী লিল ফাতাওয়া ফিল্ ফিক্হ ওয়া উলূমিত তাফসীর ওয়াল্ হাদীছ ওয়াল্ উছূল ওয়ান্ নাহ্ব ওয়াল্ ই’রাব ওয়া সায়িরিল ফুনূন অধ্যায়: আছ-ছিদাক পরিচ্ছেদ: ওয়ালীমাহ্ প্রসঙ্গ: হুসনুল মাকছিদ ফী আমালিল মাওলিদ ১ম খ- ১৯৬ পৃষ্ঠা প্রকাশনা: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ্ বইরূত নেবানন প্রকাশকাল: ১৪০৮ হিজরী মোতাবেক ১৯৮৮ হিজরী)
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমের ঘটনা থেকে অবশ্যই পবিত্র ঈদে মীলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালনের দলীল উপস্থাপন করা যাবে।